এইচআইডি এর পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি রূপ হলো Human Immunodeficiency Virus (HIV)। এটি অতি ক্ষুদ্র এক বিশেষ ধরনের ভাইরাস ।
এটি এক ধরনের RNA ভাইরাস। এ ভাইরাসটি প্রধুমাত্র মানবদেহে এবং মানুষের রক্ত এবং রক্তজাত উপাদানে বেঁচে থাকতে পারে। এবং এইচআইভি নির্দিষ্ট কয়েকটি উপায়ে মানবদেহে প্রবেশ করে দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়।
এইডস এর পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি রূপ হলো Acquired Immune Deficiency Syndrome (AIDS) এইচআইভি কয়েকটি নিদৃষ্ট উপায়ে মানব দেহে প্রবেশ করে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক পর্যায়ে অতিরিক্ত পরিমাণে ধ্বংস করে দেয় এইচআইভি সংক্রমণের এই সর্বশেষ পর্যায় হলো এইডস । শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি অতি সহজেই অন্য যে কোন সুযোগসন্ধানী রোগে আক্রান্ত হয়। এইডস এর কোন কার্যকর প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কৃত হয় । নি। সে কারণে এইডস-এ আক্রান্ত ব্যক্তির অনিবার্য পরিণতি অকাল মৃত্যু। মানবদেহে এইচআইতি প্রবেশ করে সাথে সাথেই শরীরে এইডস এর লক্ষণ দেখা যায় না।
এইচআইভি শরীরে প্রবেশ করার ঠিক কত দিন পর একজন ব্যক্তির মধ্যে এইডস এর লক্ষণ দেখা দেবে তা ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা এবং অঞ্চল ভেদে ভিন্নতর হয়। তবে এটি মনে করা হয়ে থাকে যে, এইচআইভি সংক্রমণের শুরু থেকে এইডস এ উত্তরণ পর্যন্ত সময়কালের ব্যাপ্তি সাধারনত কয়েক মাস থেকে থেকে বেশ কয়েক বছর এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ বছর অথবা তারও বেশি। উল্লেখ্য যে, এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত একজন ব্যক্তি (যে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ) তার অজান্তেই অন্য একজন সুস্থ ব্যক্তির দেহে এইচআইভি ছড়িয়ে দিতে পারে।
১৯৭০ সালের শেষ দিকে পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকায় এইচআইভি এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়, তবে তখন ভাইরাসটি আবিষ্কৃত হয় নি। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস এ সর্বপ্রদান এইডস এর লক্ষণযুক্ত রোগী শনাক্ত হয় যারা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। ১৯৮২-৮৫ সালে পশ্চিম ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও থাইল্যান্ডে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালে প্যারিসে এ ধরনের রোগীর শরীরে নতুন এক রকমের ভাইরাস আবিষ্কৃত হয় । ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের রোগীর শরীরে একই রকমের ভাইরাস পাওয়া যায়। শরীরে এই নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ক্ষমতা পর্যবেক্ষণের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠিত হয় যে, নব আবিষ্কৃত এ ভাইরাসটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়। ১৯৮৬ সালে এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয় 'এইচআইভি'। বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি প্রথম শনাক্ত করা হয় ১৯৮৯ সালে।
যেসব উপারে এইচআইভি ছড়ায়। বিভিন্ন উপায়ে এইচআইভি মানবদেহে সংক্রমিত হয়। নীচে এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান। উপায়সমূহ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:
১) অনৈতিক ও অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কের মাধ্যমে:
• এইচআইভি এবং এইডস সংক্রমিত কোন নারী বা পুরুষের সাথে অন্য কোন নারী বা পুরুষের অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কের মাধ্যমে । উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী শতকরা ৮০ ভাগ এইচআইভি সংক্রমণ নারী-পুরুষের অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কের মাধ্যমে ঘটে থাকে।
২) এইচআইভি সংক্রমিত রক্ত এবং অপারেশনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে
• এইচআইভি সংক্রমিত রক্ত গ্রহণ করলে।
• এইচআইভি সংক্রমিত অংগ (যেমন- কর্ণিয়া, হৃদপিন্ড, কিডনী ইত্যাদি) বা কোষসমষ্টি কোন ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে; এবং
• এইচআইভি সংক্রমিত সূচ বা সিরিঞ্জ কোন ব্যক্তি কর্তৃক অপরিশোধিত অবস্থায় ব্যবহার এবং অপারেশনের যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলে ।
৩) এইচআইভি বা এইডস-এ আক্রান্ত মায়ের মাধ্যমে:
• এইচআইভি বা এইডস-এ আক্রান্ত মায়ের মাধ্যমে (গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময়ে এবং মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে) তার শিশু সংক্রমিত হতে পারে ।
• আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত থালা-বাসন, কাপ, গ্লাস ইত্যাদি ব্যবহার করলে;
• আক্রান্ত ব্যক্তির সংগে করমর্দন, কোলাকুলি করলে বা এক সঙ্গে খেলাধূলা /লেখাপড়া করলে বা অন্যান্য স্বাভাবিক সামাজিক মেলামেশা করলে;
• আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জামা-কাপড় ব্যবহার করলে;
• আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত পায়খানা / প্রস্রাবখানা ব্যবহার করলে;
• মশা বা অন্য কোন পোকার কামড়ে;
• আক্রান্ত ব্যক্তির সংগে এক ঘরে বসবাস করলে বা একই বিছানায় শুলে;
• এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সেবা করলে;
• এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে; এবং
• থালাবাসনে একই সাথে খাওয়া-দাওয়া করলে এবং একই পুকুরে বা একই বাথরুমে গোসল করলে ।
ভাইরাস দেহে প্রবেশ করার ২-৪ সপ্তাহ পর আক্রান্ত ব্যক্তির হাল্কা জ্বর, র্যাস, দুর্বলতা, গলা ব্যথা, হাতে পায়ে ব্যথা, মাথা ব্যথা, মুখে ঘা ইত্যাদি হতে পারে। এ সময় ভাইরাসের সংখ্যা অত্যধিক থাকে । এরপর ৩-১২ সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রবলভাবে প্রতিক্রিয়া করে এবং এইচআইভি'র বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে, যার ফলে ভাইরাসের আক্রমণ কিছুটা মন্থর হয় । ৩-১২ সপ্তাহ পরে রক্ত পরীক্ষা করলে এইচআইভি এন্টিবডি পাওয়া যাবে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত প্রায় ৫-১০ বছর (ক্ষেত্রভেদে ১৫ বছর পর্যন্ত) কোন রকম উপসর্গ ছাড়া থাকতে পারে কিন্তু দেহের CD4 কণিকাগুলো এ সময় ধীরে ধীরে ভাইরাস দ্বারা ধ্বংস হতে থাকে। এই ৫-১০ বছরকে বলা হয় ভাইরাসটির সুপ্তাবস্থা (Latent Period)। ৫-১০ বছর পর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতই কমে যায় যে তখন আক্রান্ত ব্যক্তিকে নানা রকম সুযোগসন্ধানী রোগ (Opportunistic Infections) আক্রমণ করে। একজন এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তির মধ্যে যখন এক বা একাধিক সুযোগসন্ধানী রোগের সংক্রমণ ও লক্ষণ দেখা দেয়, তখন ঐ অবস্থাকে এইডস বলা হয়, যা সাধারণত পরবর্তী ২-৩ বছরে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে ।
এইডস এর নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নেই । তবে, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য যে সুযোগসন্ধানী রোগে আক্রান্ত হয় সে রোগের লক্ষণ দেখা যায়। এ লক্ষণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,
• শরীরের ওজন অতি দ্রুত (শতকরা ১০ ভাগের বেশি) হ্রাস পাওয়া;
• দু'মাসেরও অধিক সময় ধরে পাতলা পায়খানা;
• অজানা কারণে দু'মাসেরও অধিক সময় ধরে পুনঃ পুনঃ জ্বর হওয়া বা রাতে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া;
• শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ দেখা দেওয়া;
• লসিকা গ্রন্থি (Lymph Node) ফুলে যাওয়া;
• অতিরিক্ত অবসাদ অনুভব করা; এবং
• দীর্ঘদিন ধরে শুকনো কাশি থাকা ইত্যাদি ।
মানবদেহের যে সকল তরল পদার্থে বেশি পরিমাণে এইচআইভি ভাইরাস থাকে-
সংক্রমিত মানবদেহের ৪টি তরল পদার্থে এইচআইভি সবচেয়ে বেশি থাকেঃ
• রক্ত;
• বীর্য;
• সেক্সজুয়াল ফ্লুইড ; এবং
• মায়ের বুকের দুধ ।
এছাড়াও মুখের লালা, ঘাম ও প্রস্রাবে সামান্য পরিমাণে এইচআইভি থাকে, যা সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট নয় ।